ভূমিকা : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এদেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোকের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। কারণ, তাদের আয় কম। এছাড়াও এদেশ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যায় এমতাবস্থায় এদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনসাধারণের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদার প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ সামাজিক পরিস্থিতিকে করে তুলেছে বিপর্যন্ত। এহেন পরিস্থিতি দেশে সামগ্রিক পরিস্থির উপর প্রভাব ফেলছে চরমভাবে। আর তারই পরিণতিতে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন অশ্বের মতো ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বগতিতে। দ্রব্যমূল্য এমন এক পর্যায়ে এসে গেছে যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে বললেও অত্যুক্তি হয় না। এ অবস্থার নিরসন কোথায় তা কেউ জানে না বা বলতেও পারবে না।
দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির কারণসমূহ
জনসংখ্যা বৃদ্ধি : সমগ্ৰ বিশ্বই আজ জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে ভারাক্রান্ত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ সমস্যা আরও প্রকট। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশ। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনবিশিষ্ট এদেশে প্রায় ১৭ কোটি লোক বাস করে। আয়তনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই মারাত্মক। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে যে উৎপাদন হয়ে থাকে তা দিয়ে এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না তাই যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় দ্রব্যমূল্য খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে অনেকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে থাকে যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক। সুতরাং জনসংখ্যার বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা- রাখে।
কৃষি উৎপাদন হ্রাস : বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি উৎপাদন হ্রাসের অন্যতম কারণও হলো কৃষক সময় মতো সার, বীজ, কীটনাশকের মতো প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পায় না। এছাড়া অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস করে থাকে। আর এ হ্রাসের ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটতে বাধ্য। কৃষকরা অনেক সময় মৌসুমের পূর্বে স্থানীয় সুদখোর মহাজন, টাউটবাটপারের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয় এবং তা পরিশোধ করার সময় তার জমির ফসল উক্ত মহাজনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় । এভাবে উৎপাদিত ফসল কুক্ষিগত হয়, যার ফলে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা : দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে অর্থাৎ, রাজনৈতিক আন্দোলন, ধর্মঘট, হরতাল, মারামারি, হানাহানি- ইত্যাদি কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্যসামগ্রী পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ফলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী নষ্ট হয়ে যায় যা পরবর্তীতে দ্রব্যের সংকট সৃষ্টি করে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বিশেষকরে শহরাঞ্চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী; যেমন- চাল, ডাল, শাকসবৃদ্ধি, মাছচা মাংস ইত্যাদির দাম বেড়ে যায়। আর একবার যার দাম বাড়ে তা আর কোনোদিনই কমে না। অন্যদিকে শহরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত দ্রব্য গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার কথা তাও পরিবহনের অভাবজনিত কারণে যেতে পারে না, ফলে সেগুলোর দামও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সুতরাং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিক জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষভাবে দায়ী।
সামাজিক ব্যবস্থা : মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব সেহেতু সমাজে সকলের সাথে তাল মিলিয়েই চলতে হয়। মানুষের এ তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা থেকেই জন্ম নেয় প্রতিযোগিতা। প্রতিবেশীর ঘরে যে জিনিস আছে তার সাথে টেক্কা দিয়ে তার চেয়ে বেশি দামে জিনিসপত্র ক্রয় করে। বাহাদুরি করার মানসিকতা আমাদের সমাজে বিরল নয়। এজন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হন না অনেকে। এভাবে প্রতিযোগিতার ফলে জিনিসের দাম বৃদ্ধি ঘটে থাকে।
প্রশাসনিক দুর্নীতি : আমাদের বাংলাদেশে বর্তমানে প্রশাসনিক দুর্নীতি বিরল ঘটনা নয়। অবৈধ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের নাকের ডগার ওপর দিয়েই অবৈধভাবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে থাকে; কিন্তু প্রশাসন তা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। এছাড়া ঘুষ খেয়ে এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদেরকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার নজিরও কম নয়। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্দ্রে অনুপ্রবেশ করেছে। তাই দুর্নীতিবাজদের খপ্পরে পড়ে সমাজ আজ দিশেহারা। দুর্নীতি যেখানে নীতি সেখানে সাধারণ জনজীবনে সুখের চিন্তা আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র।- কাজেই যারা দুর্নীতি করে দুপয়সা বাড়তি রোজগার করে থাকে তারাই বাজারে গিয়ে বেশি দামে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে থাকে, যার ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ৷ প্রতিকার :
১) জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করে চাহিদার পরিমাণ কমাতে হবে এবং জোগান বৃদ্ধি করতে হবে।
২) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নির্ভর করে। সুতরাং রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাতে স্থিতিশীল থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩) তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেখানে শিল্পের উন্নতি ঘটিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে শিল্পের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি সাধিত হয়নি। পূর্বের ২/৪টা শিল্পকারখানা ছাড়া আর তেমন কোনো কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। তাই শিল্পোৎপাদনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। উপরন্তু শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হলে তাই শিল্প স্থাপন করতে হবে।
৪) কালোবাজারি ও মজুতদারগণ অধিক লাভের আশায় স্থানীয় দ্রব্যসমূহ কুক্ষিগত করে রাখে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে থাকে। চোরাকারবারিরা দেশ থেকে কম দামে দ্রব্য কিনে রাতের আঁধারে অন্যদেশে পাচার করে থাকে। এ কারণে দেশে পণ্যসামগ্রী ঘাটতি দেখা দেয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। তাই কালোবাজারি ও চোরাকারবারি রোধ করতে হবে।
৫) দেশের বিভিন্ন বড় শহর থেকে ছোট হাটবাজার পর্যন্ত সর্বত্রই চাঁদাবাজ ও মস্তানচক্র কলকারখানার মালিক থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পর্যন্ত সবার কাছ থেকেই জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে থাকে। এতে এসব কলকারখানার মালিক বা ব্যবসায়ীগণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে এ চাঁদার টাকা পুষিয়ে নিয়ে থাকে। তাই চাঁদাবাজি ও মাস্তানি রোধ করতে হবে।
৬) দেশের যেকোনো উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারি কর প্রদানের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থার জটিলতার কারণে অনেক সময় ব্যবসায়ী, উৎপাদক, সরবরাহকারীরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে থাকে এবং বাজারে তার প্রতিক্রিয়া ঘটে। তাই কর ব্যবস্থায় বিদ্যমান জটিলতা নিরসন ও কর ব্যবস্থা সহজিকরণ করতে হবে।
৭) কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কৃষকদের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণদান, ভালো বীজ সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশকের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৮) কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করে তার উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বন্ধ কলকারখানা চালু করে তার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
৯) সমাজ থেকে কালোবাজারি, সুদখোর, মজুতদারদের উৎখাত করতে হবে। এজন্য শুধু সরকারিভাবে না করে সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা যেতে পারে।
১০) ঘুষ-দুর্নীতির মতো অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সাথে সাথে তীব্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
১১) প্রতিটি দোকানে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে দ্রব্যমূল্যের তালিকা সরকারিভাবে প্রদান ও তা সংরক্ষণ এবং তদনুসারে বেচাকেনা করা বাধ্যতামূলক করা।
উপসংহার: যেসব কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটে সেগুলো প্রতিরোধ করতে পারলেই বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। সুতরাং আমাদের উচিত উক্ত কারণসমূহের উৎস খুঁজে বের করা এবং তার প্রতিকার করা।
0 Comments