Header Ads Widget

শ্রমের মর্যাদা / শ্রমের মূল্য / জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের গুরুত্ব / সভ্যতা বিকাশে শ্রমের অবদান / পরিশ্রমের মর্যাদা / কায়িক শ্রম / জীবন গঠনে শ্রমের গুরুত্ব

“বিশ্বপিতার মহা-কারবার এই দিন দুনিয়াটা
মানুষই তাহার মহামূল্যবান, কর্ম তাহার খাটা।”—যতীন্দ্রমোহন বাগচী

ভূমিকা : পৃথিবীতে সকলকে সাধ্যমত পরিশ্রম করতে হয়, শ্রম দিতে হয়। সভ্যতার এ চরম বিকাশের মূলে আছে যুগ-যুগান্তরের লক্ষ-কোটি মানুষের অফুরন্ত শ্রম । বহু মানুষ তাদের বহুদিনের শ্রম তিলে তিলে দান করে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এই অনবদ্য তিলোত্তমা মূর্তি। তাদের নাম ইতিহাসে লেখা নেই। সকলের পরিশ্রম বা শ্রমের যৌথ প্রয়াসে সম্ভব হয়েছে সভ্যতার এ অনবদ্য বিকাশ। সভ্যতা মানুষের শ্রমেরই সম্মিলিত যোগফল ।

শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ছোট হোক বড় হোক সকলেরই কাজের প্রয়োজন আছে এবং যার যার দায়িত্ব যথাযথ পালনের মধ্যে জীবনের সুখকর অস্তিত্ব নির্ভরশীল। জীবনের উন্নতির চাবিকাঠি পরিশ্রমের মধ্যে বিদ্যমান। শ্রমের এই অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনায় শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। আজকের বিশ্বের বিপুল অগ্রগতির পেছনে যেমন শ্রমজীবী মানুষের অবদান রয়েছে, তেমনি শ্রমজীবী সমাজের অসহযোগিতা জীবনকে বিষময় করে তুলবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, শ্রমের প্রতি তারা মর্যাদাশীল বলে তাদের উন্নতি এত ব্যাপক হয়েছে। সেসব দেশে ছোট বড় বলে কোনো পার্থক্য নেই। কাজ যাই হোক না কেন তাতে কোনো অমর্যাদা লুকিয়ে থাকে না। কায়িক বা দৈহিক পরিশ্রম সেসব দেশে কখনো কোনো অগৌরব নিয়ে আসে না। তাই সকলেই সব রকম কাজের প্রতি সমান আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। জীবনের সাথে শ্রমের একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান

শ্রমের প্রকারভেদ : শ্রম প্রধানত দু প্রকার— দৈহিক বা কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম। মানবসমাজে দু ধরনের শ্রমেরই মূল্য আছে। যারা দেহ খাটিয়ে পরিশ্রম করে, তাদের শ্রমকে দৈহিক বা কায়িক শ্রম বলে। আর যে শ্রমে বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগানো হয়, তাকে বলে মানসিক শ্রম। জীবন পথে চলতে গেলে উভয় প্রকার শ্রমেরই প্রয়োজন রয়েছে।

ভাগ্যরচনা ও প্রতিভা বিকাশে শ্রম : মানুষ একদিকে যেমন সভ্যতার স্রষ্টা, অন্যদিকে তেমনি নিজের ভাগ্যেরও নির্মাতা। নিজের ভাগ্যকে মানুষ নিজেই নির্মাণ করতে পারে। তার ভাগ্য নির্মাণের হাতিয়ার হলো তার পরিশ্রম। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে সুপ্ত প্রতিভা। পৃথিবীতে যে সকল ব্যক্তি প্রতিভাবান বলে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাঁরা আজীবন করেছেন কঠোর পরিশ্রম এবং তার ফলে তাঁদের প্রতিভা ফুলের মতো বিকশিত হয়ে পৃথিবীকে বিতরণ করেছে অনাবিল সৌরভ। পরিশ্রমই মানুষের প্রতিভা বিকাশ ও ভাগ্য গঠনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার । শ্রমের এই গুরুত্ব বিবেচনা করেই পাশ্চাত্য মনীষী Virgil বলেছেন, "The dignity of labour makes a man self-confident and high ambitious So, the evaluation of labour is essential." 

সব ধর্মে শ্রমের মর্যাদা : ইসলাম ধর্মে শ্রমের গুরুত্ব ও শ্রমিককে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আমাদের মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) নিজেও শ্রমিকের মতো বহু পরিশ্রমের কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মাঠে মেষ চরিয়েছেন। শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার আগে তার পাওনা পরিশোষের নির্দেশ দিয়েছেন । ফলে ইসলামে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ও অন্যান্য ধর্মেও শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শ্রমের মূল্যায়ন করা হয়েছে যথাযথ সম্মানের সাথে। কেননা বিশ্ব সভ্যতায় শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।

শ্রমের জয় : শ্রমিক সমাজ আজ বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানবিক শ্রমকে তার যোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কালের যাত্রায় একমাত্র তারাই আজ সমাজের রথকে গতি দিতে পারে, একমাত্র তারাই পারে সমাজে কর্মমুখরতার ঢেউ আনতে। তাই আজ শ্রমের জয় বিঘোষিত হচ্ছে দিকে দিকে । শ্রমিক দুনিয়ার প্রতি সকলের দৃষ্টি আজ আকৃষ্ট হয়েছে। দেশে দেশে আজ শ্রমিক সংঘ এবং শ্রমিক কল্যাণ স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সমাজ কাব্যে উপেক্ষিত এই শ্রমকে তার যোগ্য সম্মান না দিলে যে সমাজের উত্থান নেই, অগ্রগতি নেই—এ কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু শ্রমিক সমাজকেও মনে রাখতে হবে যে, শ্রেণিস্বার্থ নয়, সমবন্টনই কাম্য। সমাজের সম্পদ, তার যাবতীয় সুযোগসুবিধা সকল মানুষের জন্য সমভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত। বুদ্ধিবল, বাহুবল, অর্থবল এবং শ্রমবল সমাজের সবই প্রয়োজন। সমাজের বেদিমূলে সবাই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রমদান করবে। তার বিনিময়ে প্রত্যেকে তার ন্যায়সংগত মূল্য পাবে। এটাই বর্তমান যুগের আদর্শ হওয়া উচিত ।

বাংলাদেশে শ্রমের স্থান : বাংলাদেশে শ্রমবিভাগ ছিল প্রধানত বর্ণগত। যারা উঁচু বর্ণের তারা কোনো কাজ করত না। নিচু বর্ণের লোকেরা দৈহিক বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ করত। তাতে সমাজে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, যারা শারীরিক পরিশ্রম করে তারা সমাজে সম্মানের পাত্র নয়। এভাবে কায়িক পরিশ্রম আমাদের দেশে অবজ্ঞা পায় এবং আমরা কর্মবিমুখ হয়ে পড়ি। এটাই আমাদের অবনতির মূল কারণ।

শ্রমের সুফল : পরিশ্রম ছাড়া সমাজের কোনো কাজই সম্পাদিত হতে পারে না। সমস্ত কাজই পৃথিবীর কাজ। পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি ও দেশ তত উন্নত। পৃথিবীর মানুষ হিসেবে সকল কাজই মানুষের করণীয়। তাতে যেমন কাজের কোনো জাতিভেদ নেই, যারা সেই কাজ করে তাদেরও কোনো জাতিভেদ নেই। সুতরাং পরিশ্রম করা মোটেই সম্মান হানিকর নয়। এতে ব্যক্তির আত্মোন্নয়ন যেমন হয়, তেমনি হয় দেশের কল্যাণ। কায়িক ও মানসিক উভয় প্রকার শ্রমের মাধ্যমেই ব্যক্তি এবং জাতি মাথা উঁচু করে চলতে পারে। জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের গুরুত্ব অনেক। শ্রমবিমুখ জাতির পতন অনিবার্য। জগতের মহামনীষীরা সবাই পরিশ্রম করেছেন এবং শ্রমের মর্যাদা দিয়ে গেছেন। এত যেসব কীর্তি স্থাপিত হয়েছে সেগুলোর মূলে রয়েছে মানুষের চিন্তা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায় । শ্রমকে ঘৃণার চোখে বিচার করলে দেশে উৎপাদনের জোয়ার আনা যায় না, জাতীয় সমৃদ্ধির স্বপ্ন রচনা করা যায় না। শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেই পরিশ্রমের প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব। তাই সব শ্রমেরই মর্যাদা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাহলে যারা শ্রম দেয় তারা আর শ্রমবিমুখ থাকবে না এবং দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

উপসংহার: জীবনের সর্বক্ষেত্রে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রমিক দুনিয়াকে অভুক্ত রেখে কিংবা তাদের ঘৃণায় অপমানে সমাজের দুর্বলতম শ্রেণিতে পরিণত করে দেশে উৎপাদনের জোয়ার আনা যায় না, জাতীয় সমৃদ্ধির স্বপ্ন রচনা করা যায় না। অথচ মানুষের পরিশ্রমকে কোনো সমাজ কোনো কালেই তার যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। যারা সত্যিকার অর্থেই জীবনে সম্মান পেয়েছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, পরিশ্রমেই জীবনের প্রকৃত আনন্দ । পরিশ্রমই জীবনের অশেষ দুঃখ-কষ্ট থেকে মানুষকে মুক্তির সন্ধান দেয়। তাই সব শ্রমের মূর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন ।

Post a Comment

0 Comments