ভূমিকা : সৃষ্টির প্রথম প্রভাতে মানুষ নিজেকে জেনে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। অন্যের কাছে নিজেকে জানাতে চেয়েছে সে। মানুষ তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখানুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করে তৃপ্ত হতে চায়। এ জানানোর মধ্য দিয়েই তার আনন্দ। এ আনন্দের জোগান দিতে পারে বই। আরবি ভাষায় একটি বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য আছে 'অখাইরো জালিদিন ফিজ জমানে কিতাবুন'। অর্থাৎ সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হলো বই। কেবল তাই নয়, বই মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশমাধ্যম। যুগ যুগ ধরে অনুসন্ধিৎসু মানবগোষ্ঠী তার যাত্রাপথে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, তারই লিখিত রূপ হলো বই। মানুষ জীবনে অনেক কিছু পায় এবং হারায় আরও অনেক বেশি। মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। মানুষের এই প্রাপ্তি এবং বঞ্ছনা, সফলতা ও ব্যর্থতা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার একত্র প্রকাশ হলো বই। বই মানুষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে চিরকাল । তাই মানবজীবনে বই পাঠের গুরুত্ব অনেক।
বই পড়ার গুরুত্ব : সুধী ব্যক্তিরা বলেন, 'Reading makes a man complete- অর্থাৎ কেবল অধ্যয়নই মানুষের জীবনে পরিপূর্ণতা দান করতে সক্ষম । একথা বলাবাহুল্য, বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষই অপূর্ণতার বেদনায় আক্রান্ত । তাই বাস্তবে অপূর্ণ মানুষ গ্রন্থের মাঝে পূর্ণতার স্বাদ পেতে চায়। শুধু তাই নয়, বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভের একান্ত প্রয়োজন। তাই বই পড়া মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ কেবল খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্যই পৃথিবীতে আসে নি। তার অনেক সাধ, অনেক স্বপ্ন। মানুষ পেতে চায় অনিকেত জগতের অফুরন্ত আনন্দ। এ আনন্দ পবিত্র, এ আনন্দ শাশ্বত প্রেরণার উৎস। মানুষের তাই সাংসারিক জগতের বাইরে কোনো না কোনো বাড়তি সখ থাকে। বলাবাহুল্য, বই পড়া অতি উন্নত সখ। বই পড়লে আমরা কেবল নানা বিষয়ে জ্ঞানলাভই করি না, পাই অনন্ত আনন্দধারা। কবি ওমর খৈয়াম দুঃখ-কষ্টময় বাস্তব সংসারে নিষ্কলুষ আনন্দের রোমান্টিক পরিবেশ কল্পনা করেছেন। তাঁর সেই কাল্পনিক জগতে রয়েছে প্রেয়সী, রুটি, মন, নির্জন বনভূমি এবং একটি মহৎ গ্রন্থ। বলাবাহুল্য, কবির উল্লিখিত জিনিসগুলোর মধ্যে কেবল বই চির নবীন, চির অমর আনন্দ সাথি হিসেবে টিকে থাকতে পারে। এখানে বইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য।
বই পড়া সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “জ্ঞানের ভাণ্ডার যে ধনের ভাণ্ডার নয় এ সত্য তো প্রত্যক্ষ । কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও সমান সত্য যে, এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য, সে জাতি ধনের ভাঁড়েও ভবানী। তারপর যে জাতি মনে বড় নয়, সে জাতি জ্ঞানেও বড় নয়, কেননা, ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞানসাপেক্ষ তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টিও মনসাপেক্ষ।” মানুষের এই মন সচল এবং সমৃদ্ধ হয় বই পড়ার মাধ্যমে। কাজেই বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
মনের মতো বই নির্বাচন : বই পড়ার আনন্দকে স্বাধীন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপভোগ করতে হলে পাঠককে মনের মতো বই নির্বাচন করা একান্ত জরুরি। বই যেহেতু জ্ঞানের আধার সেহেতু মনের ইচ্ছা এবং কৌতূহল অনুযায়ী বই নির্বাচন করলে একজন পাঠক বই পাঠের অনাবিল আনন্দ সহজেই উপভোগ করতে পারেন। সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ক বই এখন সহজেই আমরা পেতে পারি। বর্তমানে ছাপাখানার সুবাদে বই তৈরি এবং সংগ্রহের কাজটি অনেক সহজ হয়েছে। যে বই মানুষ এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর সেই বই পাঠের জন্য নির্বাচন করা উচিত । এছাড়াও বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুজনদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে ।
বই বিনোদনের মাধ্যম : বেঁচে থাকার স্বার্থেই মানবজীবনে আনন্দ প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তব সংসারে নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত ও নিষ্কলুষ আনন্দ খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। আমরা দেশভ্রমণ করে আনন্দ লাভ করতে পারি। কিন্তু সেখানে অটুট স্বাস্থ্য ও অঢেল টাকার প্রয়োজন। তা অনেকেরই নেই। আমরা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সাথে মেলামেশা করেও আনন্দ লাভ করতে পারি। কিন্তু কোনো মানুষই নিঃস্বার্থ নয়। তাই মানুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশাতে অনেক সময় স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেধে যেতে পারে। আমরা ধন সঞ্চয় করে মানসিক তৃপ্তি পেতে পারি। কিন্তু ধন সঞ্চয়ে রয়েছে এক প্রচণ্ড নেশা এবং এ নেশা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষকে করে চরম স্বার্থপর ও বিপথগামী। আমরা তীর্থক্ষেত্র পরিভ্রমণ করে, ধর্মকর্ম পালন করে, লোকসেবা করে, ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, গান গেয়ে আনন্দ পেতে পারি। কিন্তু এসব উৎস থেকে আহরিত আনন্দ সকলে সবসময় সমানভাবে লাভ করতে পারে না। এসবের তুলনায় বই একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ মাধ্যম। কারণ একটি দুটি নয়, নানা বিষয় ও নানা রুচির ওপর অজস্র বই রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কাজেই আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ রুচিমাফিক বই বেছে নিতে পারি এবং আমাদের বাছাই করা বইয়ে চিরকালের আনন্দ খুঁজে পেতে সক্ষম হই।
নিঃসঙ্গ জীবনে বই : নিঃসঙ্গতার সঙ্গী বই। জনৈক মনীষী বলেছেন, “বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিত্য কথা হয়। আর নিত্য কথা বলা থেকেই জন্ম নেয় এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দের। বই তাই মানুষের অবসাদক্লিষ্ট মুহূর্তকে ভুলিয়ে দিতে পারে আনন্দের অমিয় ধারায় প্লাবিত করে দিয়ে বইকে তাই বলা হয় অবসর যাপনের উৎকৃষ্ট সঙ্গী। প্রকৃতপক্ষে বইয়ের মতো এমন আনন্দদায়ক সঙ্গী পৃথিবীতে আর নেই। এজন্যই ওমর খৈয়াম বেহেশতের সরঞ্জামের তালিকা করতে গিয়ে বইকে বাদ দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়। "
আমরা বাস্তব জীবনে অনেক সময় বিপদাপন্ন হই। বিপদ আসে বাইরে থেকে, বিপদ আসে মনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেও। আর সেই বিপদ মুহূর্তে অন্য মানুষের কাছে পরামর্শ নিতে গেলে অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে থাকি। কিন্তু প্রকৃত বই বিপদের সময় যথার্থ বন্ধুর মতো আমাদের সঠিক পরামর্শ দান করে । মানুষ যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, বার্ধক্যে জরাব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে তখন সে বড় বেশি নিঃসঙ্গ ও একাকী হয়ে পড়ে। মানুষের সেই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে কেবল একটি সুন্দর বই-ই প্রকৃত আনন্দ দিতে পারে।
চিত্তের প্রশান্তি : যে মানুষ বই পড়ে, সে মুক্তকণ্ঠে বলতে পারে, “যুক্ত কর হে সকল বন্ধন, যুক্ত করহ সবার সঙ্গে।” আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বুড়ো আংলা' বইটি পড়লে সেই কল্পিত সুবচনী হাঁসের ডানায় চড়ে বাংলাদেশের জন্মভূমি থেকে সুন্দর হিমালয়ের মানস সরোবর পর্যন্ত এক রোমান্টিক ভ্রমণের সুমহান আনন্দ লাভ করতে সক্ষম হই। অথবা আমেরিকান ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে রচিত 'The old man and the sea' উপন্যাসটি পড়লে বৃদ্ধ সেন্টিয়াগোর করুণ জীবনকথা জেনে অভিভূত হয়ে যাই। অথবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী' বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা' নিদেনপক্ষে 'ঠাকুরমার ঝুলি'র রসালো গল্পগুলো আমাদের অশান্ত মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় যা অন্য কোনোকিছু থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য পাঠককে তাই নিজের রুচি অনুযায়ী বই নির্বাচন করতে হবে। আজকাল আবার কুপাঠ্য বইয়ে বিশ্ববাজার ছেয়ে গেছে। এগুলো সামাজিক মূল্যবোধকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনষ্ট করে দেয়। কাজেই বই পড়ার আগে ভালো বই নির্বাচনের কথা অতি সতর্কতার সাথে ভাবার প্রয়োজন আছে। এমন অনেক বই আছে যেগুলোতে জীবন জিজ্ঞাসার লেশমাত্র নেই, আছে কেবল ইন্দ্রিয় বাসনার বহিঃপ্রকাশ। এসব বই আনন্দদায়ক হলেও পাঠকের জীবনের পক্ষে মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর।
বই পড়া নিয়ে প্রমথ চৌধুরীর অভিমত : বই পড়ার পক্ষে প্রমথ চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বই পড়া যে ভাল, তা কে না মানে? আমার উত্তর সকলে মুখে মানলেও কাজে মানে না। মুসলমান ধর্মে মানবজাতি দুই ভাগে বিভক্ত। এক যারা কেতাবি আর এক যারা তা নয়। বাংলায় শিক্ষিত সমাজ যে পূর্বদলভুক্ত নয়, একথা নিৰ্ভয়ে বলা যায় না; আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় মোটের উপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, সে দুই-ই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে একরকম নেই বললেই হয়; কেননা, সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না। বাধ্য হয়ে বই পড়ায় আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়েছি যে, কেউ স্বেচ্ছায় বই পড়লে আমরা তাকে নিষ্কর্মার দলেই ফেলে দিই; অথচ একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, যে জিনিস স্বেচ্ছায় না করা যায়, তাতে মানুষের মনের সন্তোষ নেই। একমাত্র উদরপূর্তিতে মানুষের সম্পূর্ণ মনসৃষ্টি হয় না। একথা আমরা সকলেই জানি যে, উদরের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের দেহ বাঁচে না; কিন্তু একথা আমরা সকলেই মানিনে যে, মনের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের আত্মা বাঁচে না।” এই মনের দাবি মেটানো যায় ভালো ভালো বই পড়ার মাধ্যমে।
উপসংহার : মহাকালের স্রোতে সকল সৃষ্টি এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের দিকে, মৃত্যুর পানে। মানবজীবনও নম্বর ক্ষণস্থায়ী। স্বল্পায়ু এ জীবনের প্রত্যেক মানুষের উচিত হাতের কাছে বইটি টেনে নিয়ে যখন যতটুকু আনন্দ রসধারা পাওয়া যায় সেটুকু তৃপ্তি সহকারে আস্বাদন করা। মানুষের অনেক আনন্দের মধ্যে বই পড়ার আনন্দই সর্বোৎকৃষ্ট। কারণ বই মানুষকে নরকের প্রজ্বলিত আগুনের মাঝে ফুলের হাসি ফোটানোর দুঃসাহস দান করে।
0 Comments