রাত ১১: ১০ মিনিট
জীবনের প্রথম ট্রেন ভ্রমণ
কদিন ধরেই নতুন একটা অনুভূতি আমাকে আলোড়িত ও রোমাঞ্চিত করছিল। ভালো ঘুমও হচ্ছিল না। পড়াশুনাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কেবলই ভাবছিলাম আর কল্পনা করছিলাম কখন ট্রেনে উঠব, কী দেখব, কী করব, কীভাবে সময় কাটাব, কতটা মজা হবে ইত্যাদি বিষয়। আগামীকাল সকাল ৭-১০ মিনিটে ইন্টারসিটি ট্রেনে আমার আকাঙ্ক্ষিত যাত্রা শুরু হবে। আমি একাই যাব এভাবেই ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু গতরাতে ছোট মামা এসে যোগ দিয়েছে। টিকিটও সেভাবেই কাটা হয়েছে, শুধু আমাকে জানানো হয়নি। আমার জন্য ভালোই হবে, মজাটা আরেকটু বাড়বে। তাছাড়া এখন সব দায়িত্ব ছোট মামার। কারণ আমি মামাবাড়িই যাচ্ছি। সূর্য উঠতেই মামা আমাকে ডেকে তুলল। তাড়াহুড়া করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হলাম। ব্যাগ রাতেই গুছিয়ে রেখেছি। এখন শুধু টুথব্রাশ আর টাওয়েলটা ঢোকানোই বাকি। মা-বাবা-ভাইয়াকে সালাম করে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু মামা কোথায়! দুই মিনিটের মধ্যে মামা রিকশা নিয়ে হাজির। ৭টার আগেই কমলাপুর পৌঁছে গেলাম। ডিজিটাল বোর্ডে ট্রেনের খবর নিয়ে আমরা ১নং প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানো ট্রেনে উঠে আসন খুঁজে নিয়ে বসে পড়লাম। এ সবই আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। একটু পরেই ঘোষণা হলো- খুলনার ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার। ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমি জানালার বাইরে মাথা গলিয়ে ট্রেনের চলা দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম সন্তানকে আদর করতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে এক মা প্ল্যাটফর্মে পড়ে গেলেন। শিশুর কান্না ভেসে আসছে। উপস্থিত লোকজন তাকে ভুলে বসিয়েছে দেখতে পেলাম। ঝক্ ঝক্ ঝকা ঝক্ শব্দে ট্রেন আপন গতিতে ছুটে চলেছে। আড়মোড়া ভেঙে শহর এখনও জাগেনি। তাই বাড়িঘর, দোকানপাট সুনসান মনে হচ্ছে। পথে-ঘাটে শ্রমজীবী কিছু মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ল। চায়ের দোকানি, ফেরিওয়ালা আর ক্রেতারা নিত্যকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ট্রেনেও উঠছে ফেরিওয়ালারা। সফট ড্রিংকস্, পানি, বিস্কুট-চানাচুর, শশা, আম, জুস, আর নাশতা-সামগ্রী বিক্রেতাদের বিচিত্র শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম হলো। তেজগাঁ, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে ট্রেন টঙ্গী এসে একটু থামল। তারপর গতি বাড়িয়ে ট্রেন চলল জয়দেবপুরের দিকে। দুপাশের গাছপালা, বাড়িঘর দ্রুত পেছনে ছুটে যাচ্ছে। মামা বলল, জয়দেবপুর থেকে ট্রেনের গতি আরও বাড়বে। ট্রেন থামলে মামা স্টেশন থেকে কলা, চিপস, চালভাজা, খোসা ছাড়ানো বাদামভাজা, স্প্রাইট, কিছু ডিম আর পানি কিনল। চলার পথে এসব খেয়েই ক্ষুধা মেটাতে হবে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন নেমে গেল। দু-চারজন নতুন লোক উঠল। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। ঝক্ ঝক্ ঝকা ঝক্ । সবুজ বনবনানী চোখে পড়ছে, বাড়িঘরও গাছপালায় ঢাকা। হালকা বৃষ্টি শুরু হলো এইমাত্র। একটা চিপস আর কলা খেয়ে স্প্রাইট খেলাম। মামা কিছু খেল না। ট্রেন ধীরে ধীরে থামছে। এটা যমুনার পূর্ব পার ইব্রাহিমাবাদ। নতুন স্টেশন দেখে ভালো লাগল। ট্রেন ধীরে চলতে শুরু করল। মামা বলল সামনেই যমুনা ব্রিজ। আমি দেখার জন্য জানালার বাইরে চোখ রেখেছি। এসে গেল মাহেন্দ্রক্ষণ। বিশাল নদীর উপর সুদৃশ্য ব্রিজ, চোখ জুড়িয়ে গেল। খুব ধীরে চলছে ট্রেন। পাশে বাস চলছে নির্দিষ্ট গতিতে। ব্রিজ পার হওয়ার সময় একটু ভীত হয়ে পড়েছিলাম । এখন তা কাটিয়ে উঠেছি। দুপাশে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা বনবনানী; কৃত্রিম পরিবেশ হলেও ভালো লাগছে। নদীর তীব্র স্রোত আর ঢেউয়ের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। মামার ঠেলায় সামনে তাকিয়ে দেখি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, নিচে পদ্মার স্রোতোময় দেহ। ওপারে কুষ্টিয়া, তারপর যশোর পার হয়ে খুলনার দৌলতপুর, যেখানে আমরা নামব। কুষ্টিয়া, যশোর কী কী জন্য কীর্তিময় মামা তা এক এক করে বলতে লাগল । চালভাজা আর বাদামভাজা কলা দিয়ে খেতে খেতে শুনতে থাকলাম সন্ধ্যার পর আমরা দৌলতপুরে নামলাম ট্রেন থেকে । নানি আর বড় মামা স্টেশনে এসেছিলেন আমাদের নিয়ে যেতে। আমার এ প্রথম ট্রেন ভ্রমণ সত্যিই আনন্দদায়ক ।
সাকিফ নেওয়াজ
নাজিরপুল, চট্টগ্রাম
0 Comments