"যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়" - আবদুল হাকিম
ভূমিকা : মানুষ ভাবের বিনিময় করে ভাষার মাধ্যমে। এ ভাষার গুণেই পৃথিবীর সকল প্রাণী থেকে মানুষ স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। মানুষ তার হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করে ভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা ছাড়া তৃপ্তি মিটিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। মাতৃভাষার এ গুরুত্বের কথা ভেবেই পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার ভেতর দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বিদেশি শাসকরা এ ভাষাকে যুগে যুগে পদানত করতে চেয়েছে। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এদেশের মানুষ। করেছে ভাষা আন্দোলন। অনেক রক্ত ঝরেছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে অকাতরে জীবন দিয়ে, তার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃত ।
ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ, বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত যে আন্দোলন হয়েছে, তাকে ভাষা আন্দোলন বলা হয়। ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল। সেখানে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গৃহীত হয় উর্দু এবং ইংরেজি। বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ মুসলিম লীগের নেতারা এর বিরোধিতা করেন। ফলে ২ মার্চ ঢাকায় ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় বাংলা ভাষার পক্ষে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয়। এ পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ছাত্ররা শোভাযাত্রা নিয়ে রাজপথে নামে। শোভাযাত্রায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি ও লাঠিচার্জ করলে অনেক ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়। এর প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন এবং ১৫ মার্চ পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, "Urdu and only Urdu will be the State Language of Pakistan." এর প্রতিবাদে ২৬ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যুর পর ১৮ নভেম্বর ঢাকায় আসেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। এর আগের দিন ঢাকায় গঠিত হয় 'রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ'। ১৯৫০ সালে গণপরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে জিন্নাহকে অনুসরণ করে লিয়াকত আলী খান বললেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” এর প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথ গরম হয়ে ওঠে এবং ৩০ জানুয়ারি পালিত হয় ধর্মঘট। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' এক সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস পালন ও হরতালের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সরকার জনরোষের ভয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, জনসভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেয়। কিন্তু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামলে পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে শহিদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত এবং নাম না জানা আরও অনেকে। শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় মর্যাদায় পালন করা হয় 'শহিদ দিবস' হিসেবে।
মাতৃভাষা দিবসের আনন্দ উৎসব : মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাতৃভাষা দিবস উৎসবের আয়োজন করে ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর। উৎসবটি পালিত হয় ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। 'একুশ আমাদের অহংকার', 'একুশ পৃথিবীর অলঙ্কার", "অমর একুশ অজয় হয়েছে –এরকম অজস্র কথা, কবিতা, গদ্য, নৃত্যছন্দে জমজমাট আনন্দ উৎসবের মধ্যে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি উপলক্ষে দিনভর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আনন্দ, শোভাযাত্রা, আলোচনা, নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পালিত হয় এ উৎসব।..
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন : ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ছুটে যায় শহিদ মিনারে। জাতিসংঘের মহাসচিব এ দিবসটি পালন উপলক্ষে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা প্রেরণ করেন। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি উদযাপন করে। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটি অব্যয় ও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বাংলাদেশের গুরুত্ব : আজ আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমরাই প্রথম জাতি, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রক্ত দিয়েছি, অকাতরে জীবন দিয়েছি। মাতৃভাষার জন্য রক্ত এবং জীবন দেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে আর নেই। সেই রক্ত বৃথা যায় নি। বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের মাতৃভাষাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি লাভের সাথে সাথে বাংলাদেশের গুরুত্বও বৃদ্ধি পেল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সেই সাথে বাংলা ভাষা হলো গৌরবের ভাষা।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালির সংগ্রামের ও আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী অনুভব করতে সক্ষম হবে, মাতৃভাষা একটি দেশের জাতিসত্তার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাই যখনই তাদের মাতৃভাষার ওপর কোনো আঘাত আসবে, তখনই তারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য। এর সাথে গুরুত্বের সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের নাম।
মাতৃভাষা দিবস প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : মাতৃভাষা দিবসের সঠিক ইতিহাস বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিম্নরূপ-
ক. মাতৃভাষা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত : আমাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে গবেষণা এবং পৃথিবীর সকল মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি 'মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গোটা বিশ্বের পাঁচ ছয় হাজার মাতৃভাষার কোনোটিই যেন হারিয়ে না যায়, এ কেন্দ্রে সেই ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার। ফলে এ কেন্দ্র একদিন বিশ্বের সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে সহায়ক হবে। এজন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে ভাষাতত্ত্ববিদ, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পণ্ডিতবর্গ ও নৃতত্ত্ববিদদের এখানে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হবে। এর ফলে বাংলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটবে বিশ্বের অনেক দেশে।
খ. বিশ্বভাষা মেলা আয়োজন: সেসময়ে ঠিক করা হয়েছিল, আগামী মহান একুশে উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজন করা হবে 'বিশ্বভাষা মেলা'। বর্ণাঢ্য এ মেলার সম্ভাব্য স্থান হচ্ছে রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। মেলার প্রধান আকর্ষণ হবে বিভিন্ন দেশের বর্ণমালা, গ্রন্থাদি ও মহান সাহিত্যিকদের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এছাড়া থাকবে ভাষা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রামাণ্য চিত্র, আবৃত্তি, সংগীত পরিবেশন ইত্যাদি। মেলায় বাংলাদেশের একটি বড় স্টলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টল থাকবে।
গ. সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট তৈরির পরিকল্পনা : বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও পরিচয় বর্ণনা করে তৈরি একটি সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট অচিরেই বিশ্বের ১৮৮টি দেশে পাঠানো হবে। এছাড়াও জাতিসংঘের ৫টি ভাষা; যথা- ইংরেজি, ফারসি, জার্মান, স্প্যানিস ও আরবিতে সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট তৈরি করা হবে।
জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে মাতৃভাষার প্রচলন : বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু জীবনের সবক্ষেত্রে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রচলন হয়নি। ব্যবসায় বাণিজ্যে, অফিস-আদালতে, উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমরা যদি জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসন লাভ করতে চাই, তাহলে উচ্চতর পর্যায়ের বইগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা জানি, বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ ভাষা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষা। এ ভাষার গঠনপ্রণালি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক। কাজেই বিদেশি ভাষার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর প্রতি ভালোবাসা প্রদান করা আমাদের কর্তব্য। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাসহ জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা যে সম্ভব, তার বাস্তব প্রমাণ আধুনিক বিশ্বের চীন, জাপান, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ। কাজেই আমরা যদি জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে চাই, তবে আমাদেরকে বিদেশি ভাষার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে প্রচলন করতে হবে।
উপসংহার : আমরা একুশ শতকে পদার্পণ করেছি। আমাদের জাতীয় জীবনে গত শতক ছিল আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম, যুদ্ধে ভরা টালমাটাল দিন । ইতিহাস থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি লাখ লাখ জীবনের বিনিময়ে। এদেশের মানুষ মাটির গন্ধ বড় বেশি ভালোবাসে। তাই তারা ভালোবাসে মাটির মাকে, আর মায়ের মুখের ভাষাকে। বাংলামায়ের সন্তানেরা বিশ্বের বুকে নতুন শতকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য আজ দৃঢ়প্রত্যয়ী। আর সেজন্য আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাতৃভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা প্রয়োজন ।
0 Comments